শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫
দেশে প্রথমবারের মতো হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসে (এইচএমপিভি) আক্রান্ত হয়ে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তবে তিনি অন্য সংক্রমণেও আক্রান্ত ছিলেন বলে জানিছেন চিকিৎসকরা।
তারা আরও জানান, ওই নারীর একাধিক জটিলতা ছিল। শ্বাসকষ্ট, হৃদযন্ত্রের জটিলতা, স্থূলতাসহ বহু জটিলতা তার অসুস্থতাকে আরও কঠিন করে তোলে। তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। তার নিউমোনিয়া ছাড়াও মাল্টি অর্গান ফেইলিউরের (একাধিক অঙ্গের নিষ্ক্রিয়তা) কারণে মৃত্যু হয়েছে। যদিও এইচএমপি ভাইরাসে মৃত্যু বিরল, এরপরও কেন মারা গেলেন ওই নারী এই নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাখা করা হয়েছে। আর এইচএমপি ভাইরাস নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে সাধারণ মানুষ। তবে রূপান্তর ছাড়া এ ভাইরাসের প্রাণঘাতী হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই।
তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইচএমপিভি নামক ভাইরাসটি নতুন কোনো ভাইরাস নয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা ধাঁচের ভাইরাস। এটা শুধু চীনেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশেও এই ভাইরাসের উপস্থিতি আরও আগেও পাওয়া গেছে, এখনও আছে। এর লক্ষণ মূলত অন্য জ্বরের মতো। আর সর্দি, কাশি হয়, নাক বন্ধ হয়ে যায়, শরীরে ব্যথা হয় এবং শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ তৈরি করে। প্রদাহ থেকে এর জটিলতা হিসেবে ব্রঙ্কিওলাইটিস অথবা নিউমোনিয়া হতে পারে। শিশু ও বয়স্কদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তবে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউনিটি) কম এবং যেসব ব্যক্তি ক্যানসার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির রোগ, সিওপিডি, অ্যাজমা বা দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা ঝুঁকি আছে এবং সতর্ক থাকতে হবে।
তাদের মতে, যখন ভাইরাসের বিস্তার হতে থাকে, তখন সেটার প্রতিনিয়ত মিউটেশন বা রূপান্তর হতে থাকে। কোভিড ভাইরাসও অনেক পুরোনো ভাইরাস ছিল। মিউটেশনের কারণে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তাই এইচএমপিভির মিউটেশন হলে এটাও ক্ষতিকর বা প্রাণঘাতী হয়ে যেতে পারে। এ কারণেই এইচএমপি ভাইরাসের বিস্তার রোধে সর্তক হওয়া জরুরি। সে ক্ষেত্রে প্রধানত হাঁচি-কাশিতে অন্য কেউ যেন আক্রান্ত না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে মাস্ক ব্যবহার, হাত ধোয়া ও মাস্কের ব্যবহারসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
সম্প্রতি চীনের পাশাপাশি অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে এইচএমপিভি আতঙ্ক। বিশেষ করে শিশুরা এ ভাইরাসে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে সতর্কতা জারি করেছে চীন। এরপর জাপান ও মালয়েশিয়ায় ভাইরাসটি শনাক্ত হয়। ভারতের কর্ণাটক রাজ্যেও আট মাসের এক শিশুর এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর আসে। এ পর্যন্ত বেশকিছু রোগী পাওয়া যায় ভারতে। আর বাংলাদেশে গত ১২ জানুয়ারি রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এক নারীর এইচএমপি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করে।
সে সময় আইইডিসিআরের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান ডা. আহমেদ নওশের আলম বলেন, আক্রান্ত নারী একজন গৃহিণী। তার বিদেশ ভ্রমণের কোনো ইতিহাস নেই। তার স্বামী বিদেশে থাকেন। আর বাংলাদেশেও এইচএমপি ভাইরাস শনাক্তের খবর আসার মধ্যে সংক্রমণ ঠেকাতে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এতে সব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং দেশের বিভিন্ন প্রবেশপথে স্বাস্থ্যবিধি জোরদার করার কথাও বলা হয়েছে। যদিও এই ভাইরাসের ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের অ্যালার্ম বা অ্যালার্ট জারি করেনি।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার এইচএমপি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ওই নারীর বয়স ৩০ বছর। তিনি ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত ছিলেন। এ ছাড়া তার কিডনি, হৃদযন্ত্রের জটিলতা, স্থূলতাসহ বহু জটিলতা ছিল। গত ১১ জানুয়ারি তাকে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর তিন দিন আগে শ্বাসকষ্টজনিত কারণে রাজধানীর গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি।
আইইডিসিআর সূত্রে জানা যায়, গত বছর এইচএমপিভি আক্রান্ত দুজন শনাক্ত হয়েছিলেন। ২০১৭ সালে দেশে প্রথমবারের মতো ভাইরাসটি শনাক্ত হয়। সেই থেকে ভাইরাসটি দেশে ছিল এবং আছে।
এইচএমপি ভাইরাস শনাক্ত হওয়া প্রসঙ্গে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন জানান, আমাদের দেশে প্রতি বছরই দু-চারজন এইচএমপিভি আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। সুতরাং, এটি নতুন কোনো ভাইরাস নয়। এটা শুধু চীনেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশেও এই ভাইরাসের উপস্থিতি আরও আগে থেকেই আমরা পেয়েছি। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এই ভাইরাসের উপস্থিতি প্রথম শনাক্ত হয়।
তাহমিনা শিরীন বলেন, আমাদের দেশে গত বছর এ ভাইরাসে আক্রান্ত দুজন শনাক্ত হয়েছিল। এর অর্থ এই নয় যে দেশে মাত্র দুজন আক্রান্ত ছিল। আক্রান্ত হয়তো আরও ছিল। তাই আমি বলছি, এর উপস্থিতি আগে ছিল, এখনও আছে।
চিকিৎসকরা জানান, বর্তমানে এইচএমপিভির চিকিৎসার জন্য কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল থেরাপি নেই এবং এইচএমপিভি প্রতিরোধ করার জন্য কোনো ভ্যাকসিন নেই। তাই রোগের উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। যেহেতু শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহের মাধ্যমে তৈরি হয়, সে ক্ষেত্রে শ্বাসযন্ত্রের অসুখের যে লক্ষণগুলো থাকে, সেগুলোই বেশি পরিমাণে দেখা দেয়-যেমন হাঁচি, কাশি, জ্বর, গায়ে ব্যথা। এ ছাড়া বমি ও ডায়রিয়াও হতে পারে। যেকোনো ফ্লুতে (যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, শিশুদের রেসপিরেটরি সিনোসাইট্রিয়াল ভাইরাস-আরএসপি বা কোভিড) যে লক্ষণগুলো থাকে, এই ভাইরাসেও এসব লক্ষণই দেখা যায়। অর্থাৎ শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ তৈরি করে এমন ভাইরাসগুলোর সাধারণ লক্ষণ এগুলো। এই লক্ষণগুলো দেখার পর এক্সরে ও রক্তের পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করা যেতে পারে, তবে নির্দিষ্টভাবে এই রোগটি নির্ণয়ের জন্য পিসিআর বা অন্য কোনো টেস্টের সহজলভ্যতা এখনও হয়নি। আর ভ্যাক্সিন না থাকার কারণে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে এর প্রতিকার সম্ভব। যে লক্ষণগুলো দেখা দেয়, তার চিকিৎসা করলেই এর প্রতিকার করা যায়।
এইচএমপিভি কি ভয়াবহ হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের। এটা তেমন ক্ষতিকর না। এটা শুধু শিশু এবং বয়স্কদের সংক্রমিত করে। মূলত শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা করে থাকে। অনেক সময় গায়ে ব্যথা, বমিও ও নিউমোনিয়া হয়। এতে মৃত্যুর শঙ্কা যে খুব একটা বেশি, তা নয়। মৃত্যুহার নেই বললেই চলে। এতে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই।
তিনি বলেন, যেহেতু এটি আসলে সাধারণ একটি ভাইরাস। আর এখন পর্যন্ত শোনাও যায়নি যে চীনে ভাইরাসটির নতুন কোনো মিউটেশন হয়েছে, যার জন্য এটি খুব প্রাণসংহারী হয়ে গেছে। সুতরাং, এই ভাইরাসের যে একিউট ইনফেকশন (শরীরে হঠাৎ করে এবং দ্রুত সময়ে ঘটতে থাকা সংক্রমণ) হচ্ছে, তাতে স্বাভাবিক প্রতিকার করলে মৃত্যুর সম্ভাবনা একদম নেই। কেউ নিউমোনিয়া থেকে মৃত্যু বরণ করতে পারে বা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে, অন্যথায় এই ভাইরাসে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এই ভাইরোলজিস্ট বলেন, কোনো ভাইরাস বা ভাইরাল ডিজিজগুলো কেন মহামারি রূপ নেয়? এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যদি আমরা জানতে চাই, তা হলে দেখা যায় ওই ভাইরাসগুলোর জিনের কিছু পরিবর্তন হয়। যেমন-ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের জিনের মধ্যে যদি কোনো পরিবর্তন হয়, সে পরিবর্তনের ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির যদি ওই ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকে, তখন ওই ব্যক্তির অঙ্গগুলো আক্রান্ত হয়, বিশেষ করে তার শ্বাসযন্ত্র এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও এতে যুক্ত হয়। আবার কোভিডের ক্ষেত্রে এই ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে আগে ছিল না। এখন পর্যন্ত এর কোনো ধরনের মিউটেশনের রিপোর্ট আমরা পাইনি। অর্থাৎ পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থায় এটি আছে। সে ক্ষেত্রে এটি প্রাণ সংহারী হওয়া অথবা এপিডেমিক বা মহামারি হওয়ার লক্ষণ বা সম্ভাবনা দেখছি না।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুসারে এইচএমপিভি ভাইরাসের কারণে মৃত্যুর ঘটনা খুবই বিরল। এ ভাইরাসে সাধারণত মৃত্যু ঘটে না। নিউমোনিয়া ও মাল্টিঅর্গান ফেইলিউরের কারণে আমাদেও দেশে সানজিদা নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে।
আশপাশের দেশে এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটছে। তবে ক্রমাগত রূপান্তর ঘটে এটি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। তাই এই বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক এজেন্সিগুলোর স্বাস্থ্যবিষয়ক কিছু গাইডলাইন আছে।
ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ভাইরাসের যখন বিস্তার হতে থাকে, তখন সেটার প্রতিনিয়ত মিউটেশন বা রূপান্তর হতে থাকে। কোভিড ভাইরাসও অনেক পুরোনো ভাইরাস ছিল। মিউটেশনের কারণে এটাও ক্ষতিকর বা প্রাণঘাতী হয়ে যেতে পারে। এ কারণেই এইচএমপিভি ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা দরকার।
তাই এ সময় কেউ ফ্লুতে আক্রান্ত হলে জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, । এলেও মাস্ক পরতে হবে। আবার কেউ অসুস্থবোধ করলে তিনি যেন ঘরে থাকেন। অসুস্থ হলে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ও স্বাস্থ্যবিধি মেন চললে এইচএমপিভি ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।