আমার দেশ ২৪
সোমবার ২০ জানুয়ারি২০২৫
গল্পে গল্পে জীবন কথাঃ
“শেষ পর্বের নিঃসঙ্গতা”
মো. কামাল উদ্দিনঃ
এটা একটি অতি হৃদয়বিদারক বাস্তব গল্প, যা আজও অনেক মানুষই চুপ করে দেখছে, কিন্তু ত থেকে শিক্ষা নেয়ার মতো কেউ এগিয়ে আসছে না। এই গল্পটি এমন একজন মানুষের, যিনি নিজের সারা জীবন ছেলেমেয়ে, পরিবার আর সংসারের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু তার শেষ সময়ে কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। কাহিনিটি শুরু হয় এমনভাবে:-রফিকুল ইসলাম ছিলেন এক নিষ্ঠাবান কর্মী, যার জীবন ছিল সাধারণ, কিন্তু সংগ্রামী। তিনি নিজের সন্তানদের ভালো শিক্ষাদীক্ষা দেয়ার জন্য রাতদিন এক করে পরিশ্রম করেছেন। তার এক ছেলে, সোহেল, এবং এক মেয়ে, মিতু, ছিল। দুই সন্তানই বাবা-মায়ের আশীর্বাদ পেয়ে বড় হয়ে ওঠে, আর রফিকুল ইসলাম তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাদের সব কিছুই দিয়ে দেন। তার জীবনের সমস্ত স্বপ্ন ছিল, তার সন্তানেরা যেন সুখে থাকে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। তবে, সময়ের সাথে তাদের মনোভাব বদলে যেতে থাকে। যখনই রফিকুল ইসলাম অসুস্থ হতে শুরু করেন, তার পায়ের নীচে মাটি সরে যেতে থাকে। ছেলেটি চাকরির তাগিদে, মেয়ে অন্য জীবনের দুশ্চিন্তায় নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের কাছে বাবার অসুস্থতা কিছুটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
একদিন, রফিকুল ইসলাম শরীর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন যে, তার অবস্থার উন্নতি খুবই দুষ্কর। তার শরীরে একটা অদৃশ্য কষ্ট ছিল যা ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করছিল। সে দুঃখে ভরা চোখে ছেলের দিকে তাকাতো, কিন্তু ছেলে কখনোই তার পাশে থাকতে পারল না। কাজের তাগিদে সোহেল বারবার মাকে ফোন করত, কিন্তু বাবা শুয়ে থাকতেন অসহায়ভাবে। মিতু, তার মেয়ে, বলতো যে সে আসতে পারবে না, কারণ তার অফিসে জরুরি কাজ ছিল। রফিকুল ইসলামের দিনগুলো একে একে কাটতে থাকে। তার প্রিয়জনেরা যখন তাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, তখন তারা দূরে সরে যায়। তার পিতৃত্বের দায়িত্ব, তার ভালোবাসা, একে একে ভুলে যায় সবাই। এভাবে, একদিন রফিকুল ইসলামের জীবন শেষ হয়ে যায়, একেবারে একা, নিষ্ঠুরভাবে জীবনের শেষ শ্বাসটুকু নিয়ে। তার জীবনের সব অর্জন, ভালোবাসা, আর কষ্টের ফলাফল ছিল একটাই— যে সন্তানদের জন্য তিনি নিজের জীবন দিয়েছিলেন, তারা তার শেষ সময়ে তার পাশে ছিল না।
তার জীবনের এই শেষ সময়টা ছিল এক অসীম শূন্যতায় ভরা। তীব্র একাকীত্ব, অবহেলা আর না পাওয়া ভালোবাসা ছিল তার মনে। মৃত্যু তার কাছে আসার আগেই, তিনি বুঝে গিয়েছিলেন— জীবনে যে কিছুই ধরে রাখা যায় না, সব কিছুই সময়ের হাতে থাকে। সন্তানের ভালোবাসা, পরিবার, সঙ্গী, এসব কিছুই সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। রফিকুল ইসলামের জীবনের এই দুঃখজনক ঘটনা আমাদের একটি বড় শিক্ষা দেয়— আমাদের কখনোই অভ্যন্তরীণ সম্পর্কগুলোকে অবহেলা করা উচিত নয়। একদিন, যখন আমাদের প্রয়োজন হবে, তখন হয়তো আমরা নিজেই একা হয়ে যাব, আর সেটা কেবল আমাদের ভুলের ফলেই ঘটবে।
-ঃএই গল্পটি একটি বৃদ্ধ বাবা, আবদুল হক, এবং তার সন্তানদের সম্পর্ক নিয়ে। আবদুল হক একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন, তার জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি তার পরিবারকে সুখী করতে কাজ করেছেন। ছোট একটা ব্যবসা চালিয়ে তিনি নিজের দুই সন্তানকে বড় করেছেন। ছেলে শাহিদ এবং মেয়ে সুমি ছিল তার আশ্রয়, তার স্বপ্ন। তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল যে, তার সন্তানরা যেন ভালো মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠে, তাদের জন্য সবার কাছে সম্মান পায়।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আবদুল হক কিছু শারীরিক সমস্যায় পড়তে শুরু করেন। তার প্রিয় ব্যবসা ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে, কারণ তার শরীর আর সঙ্গ দেয় না। কিন্তু তার কাছে ছিল আশা, যে ছেলে-মেয়ে তার পাশে দাঁড়াবে। সুতরাং, তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন। তবে, এক সময় দেখা যায়, শাহিদ আর সুমি দুজনেই তার পাশে থাকতে পারছিল না। শাহিদ শহরে ব্যস্ত কাজ নিয়ে, আর সুমি তার নিজস্ব জীবনে এতটাই ডুবে ছিল যে, বাবা কি করতে পারছে বা তার অসুস্থতা সম্পর্কে কোনো খোঁজ নেয়নি। আবদুল হক বারবার তাদের কাছে সাহায্যের আবেদন করেন, কিন্তু তারা দুঃখজনকভাবে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। একদিন, আবদুল হক হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসকরা জানান যে, তার অবস্থা খুবই সংকটজনক। কিন্তু তারপরও, কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। ছেলে শহরে চাকরির তাগিদে ব্যস্ত, আর মেয়ে পরিবার নিয়ে নিজের দুনিয়াতে মনোযোগী হয়ে গেছে। আবদুল হকের হৃদয়ে কষ্ট ছিল, কিন্তু তাকে কেউ বুঝতে পারছিল না।
শেষ পর্যন্ত, একদিন আবদুল হক একেবারে একা হয়ে যায়। তার কোনো বন্ধু ছিল না, কোনো পরিচিত ছিল না। ঘরবাড়ির চুপচাপ ভাবটা তার কাছে খুবই যন্ত্রণাদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। তবে, একদিন রাতে, সে নিজেই তার জীবনপ্রাপ্তি এবং সন্তানদের অবহেলা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ ভাবতে থাকে। মনে মনে উপলব্ধি করতে থাকে যে, জীবনে অনেক কিছু অর্জন করা যায়, কিন্তু নিজের স্নেহের সম্পর্ক আর ভালোবাসার অভাব কখনও পূর্ণ করা যায় না।
এভাবে তার জীবন শেষ হয়, একা, নিঃসঙ্গ, সন্তানের অবহেলা আর সময়ের প্রতি তার অভিযোগের মধ্যে। তার শেষ সময়টুকু ছিল একা বসে থাকার কষ্টে পূর্ণ।
গল্পটি আমাদের শেখায় যে, সন্তানরা প্রাথমিকভাবে আমাদের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় হতে পারে, কিন্তু সময় আর তাদের নিজস্ব জীবনের চাপ আমাদের সম্পর্কের মাঝে ফাটল ধরিয়ে দেয়। আমরা যখন তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, তখন তারা আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। তাদের প্রতি ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধতা যেভাবে আবদুল হক অনুভব করেছিলেন, তা কখনও প্রতিফলিত হয়নি।
শেষ জীবনে, আমরা কখনো জানি না যে আমাদের পাশে কে থাকবে, আর কে থাকবে না। আমাদের সম্পর্কগুলো যতই গভীর হোক না কেন, তাদের প্রতি অবহেলা কখনও আমাদের একাকীত্বের শিকার করতে পারে।
এই কথাগুলোর মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ আমাদের কাছে আসে: “সময়”। সময় আমাদের জীবনের চলার পথের সাক্ষী, যেখানে অনেক কিছু বদলে যায়—যারা এক সময় আমাদের কাছে প্রিয় ছিল, তারা কখনো হয়তো দূরে চলে যায়। সময়ের সাথে আমরা বুঝে যাই, কে আমাদের সত্যিকারের বন্ধু, কে পাশে থাকে, আর কে শুধু নিজের স্বার্থে আমাদের কাছে আসে। জীবনে মানুষের আসা-যাওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু সত্যিকারের সম্পর্কগুলোই সবচেয়ে মূল্যবান। তাই, যাদের পাশে পাওয়ার প্রয়োজন, তাদের প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং যারা আমাদের সত্যিকারের বন্ধু, তাদের কখনো অবহেলা না করা উচিত।
চলবে–