নোটিশ: বকেয়া পরিশোধ না হওয়ায় সাইটটি শীঘ্রই সাসপেন্ড হয়ে যাবে, অনুগ্রহ পূর্বক যোগাযোগ করুন। ধন্যবাদ।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ঈদ সংস্কৃতি।

আমারদেশ২৪
সোমবার ৩১ মার্চ, ২০২৫

দিল্লি জামা মসজিদে পবিত্র ঈদের নামাজের, নিউইয়র্ক টাইমস

ঈদুল ফিতর মুসলিম উম্মাহর জন্য অনন্য এক ধর্মীয় উৎসব। বিশ্বজুড়ে মুসলিমরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনুযায়ী ঈদ উদযাপন করে থাকেন। অনেকে এই উৎসবকে রোজা ভাঙার উৎসব হিসেবেও মনে করেন। পবিত্র রমজান মাসের সমাপ্তি টেনে মুসলিমরা আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করে। এই উৎসব মুসলমানদের ঐক্য, সংহতি এবং ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতীক।

যদিও ঈদের মূল ধর্মীয় রীতিনীতি প্রায় একই থাকে, তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি উদযাপনের ধরন ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। চলুন, এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, কীভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতিতে ঈদুল ফিতর উদযাপন করা হয়।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঈদের জাঁকজমকপূর্ণ উদযাপন
দুবাই, আবুধাবি, শারজাহসহ পুরো সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঈদুল ফিতর এক বর্ণাঢ্য উৎসব হিসেবে পালিত হয়। ঈদকে ঘিরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এক সপ্তাহব্যাপী উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। রমজানের শেষ দিনগুলো থেকে ঘরবাড়ি সাজানো শুরু হয়, নতুন পোশাক কেনা হয় এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার আয়োজনের তোড়জোড় শুরু হয়।

আরব আমিরাতের একটি মসজিদ চত্বরে ঈদের জামাত। ছবি : সংগৃহীত
আরব আমিরাতের একটি মসজিদ চত্বরে ঈদের জামাত। ছবি : সংগৃহীত

ঈদের সকাল শুরু হয় ঈদুল ফিতরের জামাতের মাধ্যমে। মসজিদ ও খোলা প্রাঙ্গণে হাজারও মানুষ একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে একে অপরকে শুভেচ্ছা জানান এবং ‘ঈদ মুবারক’ বলে সম্ভাষণ করেন।

ঈদে পরিবারের ছোট সদস্যদের জন্য ‘ঈদিয়া’ নামে নগদ টাকা বা উপহার দেওয়ার বিশেষ রীতি রয়েছে। যা আমাদের দেশে ‘সালামি’ নামে পরিচিত। পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে মিষ্টান্ন ও সুস্বাদু খাবার ভাগ করে নেওয়া হয়। জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে রয়েছে ‘লুকাইমাত’ (মধু ও খেজুর দিয়ে তৈরি মিষ্টি বিশেষ), বিরিয়ানি, মাংসের বিশেষ পদ ও সুগন্ধিযুক্ত চালের খাবার।

ঈদের অন্যতম আকর্ষণ হলো আতশবাজি প্রদর্শনী; যা দুবাই, আবুধাবি ও অন্যান্য শহরে আয়োজিত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, লেজার শো, মিউজিক্যাল ইভেন্ট এবং শিশুদের জন্য বিশেষ কার্নিভাল ও মেলার আয়োজন করা হয়।

সৌদি আরবে ঈদুল ফিতর
সৌদি আরবে ঈদুল ফিতর বড় উৎসব হিসেবে পালিত হয়। যেখানে ধর্মীয় রীতি ও ঐতিহ্যবাহী আনন্দ একসঙ্গে মিলে যায়। ঈদের উৎসব শুরু হয় নতুন চাঁদ দেখার মাধ্যমে। চাঁদ দেখা গেলে পরদিনই ঈদ উদযাপিত হয়। এ উপলক্ষে সৌদি পরিবারগুলো বিশেষ প্রস্তুতি গ্রহণ করে—যেমন, বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয়, নতুন পোশাক কেনা হয় এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার প্রস্তুত করা হয়।

সৌদি আরবে ঈদের ঐতিহ্যবাহী তলোয়ার নৃত্য উৎসব। ছবি : সংগৃহীত
সৌদি আরবে ঈদের ঐতিহ্যবাহী তলোয়ার।

মসজিদ ও বড় ঈদগাহে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় সকালে। নামাজ শেষে মুসল্লিরা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানান।

ঈদের প্রধান আকর্ষণ হলো পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়া, একসঙ্গে খাওয়া ও উপহার বিনিময় করা সৌদি সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ঈদে শিশু ও বৃদ্ধদের উপহার দেওয়া হয়।

সৌদি আরবের ঈদ উৎসবে কিছু বিশেষ ঐতিহ্যবাহী কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়—বাজ পালন; সৌদি আরবে বাজ পোষা ও প্রশিক্ষণ একটি জনপ্রিয় ঐতিহ্য। উটের দৌড়; ঈদের সময় বিশেষ উট দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ঐতিহ্যবাহী নৃত্য; ‘আর্দাহ’ নামে পরিচিত ঐতিহ্যবাহী তলোয়ার নৃত্য ঈদ উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।

এছাড়া সৌদি আরবের বড় শহরগুলোতে, বিশেষত রিয়াদ, জেদ্দাহ ও দাম্মামে, ঈদের রাতে বর্ণিল আতশবাজির প্রদর্শনী হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী, সংগীতানুষ্ঠান ও শিশুদের জন্য বিশেষ বিনোদনমূলক কার্যক্রম আয়োজন করা হয়।

তুরস্কে ঈদ: ‘শেকের বাইরামি’ উৎসবের মিষ্টিময় আনন্দ
তুরস্কে ঈদুল ফিতরকে ‘শেকের বাইরামি’ বলা হয়। যার অর্থ ‘মিষ্টির উৎসব’। এই নামটি ঈদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য—মিষ্টি খাবারের প্রচলনকে প্রতিফলিত করে।

তুর্কিরা ঈদের দিন সকালে গোসল করে পরিচ্ছন্ন হয় এবং নতুন বা সুন্দর পোশাক পরে। এরপর তারা পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের বাড়িতে যান, আশীর্বাদ ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এটি পারস্পরিক শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অন্যতম সুন্দর রীতি। শেকের বাইরামির অন্যতম আকর্ষণ হলো শিশুদের জন্য বিশেষ উপহার। বয়োজ্যেষ্ঠরা শিশুদের মিষ্টি, চকোলেট এবং নগদ টাকা দেন।

তুরস্কে ঈদের আনন্দ-আয়োজনে শিশুরা। ছবি : সংগৃহীত
তুরস্কে ঈদের আনন্দ-আয়োজনে শিশুরা।

এছাড়া তুরস্কে ঈদের দিন ঐতিহ্যবাহী খাবারের বিশাল আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হলো—বাকলাভা; যা মধু ও বাদাম দিয়ে তৈরি মিষ্টান্ন বিশেষ। হালভা; এটি সুগন্ধিযুক্ত ও সুস্বাদু একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। আর তুর্কি কফি ও চা; অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যবহৃত হয়।

নিউজিল্যান্ডে ঈদ উদযাপন
নিউজিল্যান্ডে ঈদুল ফিতর ধর্মীয় ও সামাজিক উভয়ভাবেই অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে উদযাপিত হয়। ঈদের দিন সকালে মুসলিমরা মসজিদে বা খোলা মাঠে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার ভাগ করে নেন। পরিবারগুলো একে অপরকে উপহার দেয় এবং শিশুদের জন্য বিশেষ আনন্দের ব্যবস্থা করা হয়।

সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের বড় শহরগুলোতে ঈদের উন্মুক্ত উৎসব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অকল্যান্ড, ওয়েলিংটন ও ক্রাইস্টচার্চে বিশাল জনসমাগম হয় এই উপলক্ষে। এসব উৎসবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, খাবারের স্টল এবং শিশুদের জন্য নানা বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে।

নিউজিল্যান্ডে ঈদ উৎসব। ছবি : সংগৃহীত
নিউজিল্যান্ডে ঈদ উৎসব।

অকল্যান্ডে ঈদের বিশেষ আয়োজন: অকল্যান্ডে ঈদের দিন শুরু হয় নামাজ ও পরিশুদ্ধতার মাধ্যমে। এরপর ইডেন পার্কে আয়োজিত উৎসবে অংশগ্রহণ করেন হাজারো মানুষ। এখানে থাকে—কার্নিভাল গেমস হিসেবে মেকানিক্যাল বুল রাইডিং, হিউম্যান ফুসবল এবং ফুড ভেন্ডরস, সংস্কৃতি ও বিনোদন। এতে করে এই উৎসবের মধ্য দিয়ে মুসলিম ঐতিহ্যের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের বহু সংস্কৃতির সংমিশ্রণ দেখা যায় দেশটিতে।

ঈদ ও নিউজিল্যান্ডের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি: নিউজিল্যান্ডের ঈদ উদযাপন শুধু মুসলমানদের জন্য নয়; স্থানীয়রাও এতে অংশ নেন। এতে দেশটির সম্প্রীতি ও বৈচিত্র্যের পরিচয় বহন করে। মুসলিম সংস্কৃতি ও নিউজিল্যান্ডের সামগ্রিক সংস্কৃতির মিশেলে এক অনন্য উদযাপন সৃষ্টি হয়।

ইন্দোনেশিয়ায় ঈদুল ফিতর
ইন্দোনেশিয়ায় ঈদ-উল-ফিতরকে ‘হারি রায়া ঈদুল ফিতর’ বলা হয়। উদযাপন শুরু হয় তাকবির পাঠের মাধ্যমে, যা ঈদের আগের রাত থেকে শুরু হয়। ঈদের সকালে বিশাল খোলা মাঠে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। নামাজ শেষে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে ক্ষমা চাওয়া ও শুভেচ্ছা বিনিময় ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম ঐতিহ্য।

ইন্দোনেশিয়ায় ঈদ পরিবার ও ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। ছবি : সংগৃহীত
ইন্দোনেশিয়ায় ঈদ পরিবার ও ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন।

দেশটিতে এই উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘মুদিক’, যার অর্থ নিজের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়া। লাখো মানুষ ঈদের ছুটিতে শহর থেকে গ্রামে ফিরে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেন। মুদিক এত গুরুত্বপূর্ণ যে, সরকার বিনামূল্যে গণপরিবহনের ব্যবস্থা করে।

ইন্দোনেশিয়ার ঈদ শুধু ধর্মীয় আচার নয়, এটি পরিবার ও ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন।

পাকিস্তানে ঈদের আনন্দ
পাকিস্তানে ঈদুল ফিতর একটি ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব হিসেবে পালিত হয়। ঈদের শুরুতে নতুন চাঁদ দেখা যায়, এরপর মুসলিমরা নতুন পোশাক পরে ঈদের নামাজ আদায় করেন।

পাকিস্তানে নামাজ শেষে একে অপরকে ঈদের শুভেচ্ছা। ছবি : সংগৃহীত
পাকিস্তানে নামাজ শেষে একে অপরকে ঈদের শুভেচ্ছা।

নামাজ শেষে একে অপরকে ঈদ মোবারক বলে শুভেচ্ছা জানায় এবং উপহার বিনিময় করে। পাকিস্তানে ঈদের খাবার পর্বের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিরিয়ানি, খির এবং শির খুরমা।

আইসল্যান্ডে ঈদুল ফিতর উদযাপন
আইসল্যান্ডে মুসলিমরা এখনও সংখ্যালঘু হলেও সম্প্রদায়টি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা রমজান মাসে সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত রোজা রাখেন, যা শেষ হয় ঈদুল ফিতরের আনন্দময় উদযাপনে। এই উৎসব রিকযাবিকের কয়েকটি মসজিদের মধ্যে একটি মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে অতিথিরা বিভিন্ন দেশের খাবারের আন্তর্জাতিক বাফে উপভোগ করেন।

আইসল্যান্ডে গ্রীষ্মকালে দিনের দীর্ঘতা বেশি হওয়ায়, মুসলিমরা প্রায় ২২ ঘণ্টা রোজা রাখেন। তবে ইসলামিক পণ্ডিতরা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়সূচি অনুযায়ী রোজা ভাঙার পরামর্শ দিয়েছেন, অথবা সৌদি আরবের টাইমজোন অনুসরণ করতে বলেছেন।

মিশরের ঈদ উৎসব
মিশরে ঈদের দিনটি আনন্দ, ভোজ এবং পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর মাধ্যমে উদযাপিত হয়। মিশরীয়রা এই দিনে বিশেষ খাবার তৈরি করেন। যেমন, ফাত্তা; যা চাল, মাংস এবং রুটির মিশ্রণ। কুনাফা; একটি মিষ্টি, যা পনির ও সিরাপে তৈরি হয়।

ঈদে শিশুদের জন্য মিষ্টি তৈরি করা মিশরীয়দের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। ছবি : সংগৃহীত
ঈদে শিশুদের জন্য মিষ্টি তৈরি করা মিশরীয়দের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য।

এছাড়াও নতুন পোশাক কেনা এবং শিশুদের জন্য মিষ্টি তৈরি করা মিশরীয়দের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য।

যুক্তরাষ্ট্রে ঈদুল ফিতর উদযাপন
যুক্তরাষ্ট্রে ঈদুল ফিতর মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। দেশটিতে এই উৎসব বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে উদযাপিত হয়। মুসলিমরা ঈদের নামাজ মসজিদ বা খোলা মাঠে আদায় করে এবং তারপর পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ উদযাপন করে।

এছাড়া আমেরিকান মুসলিমরা সাধারণত ‘কমিউনিটি সার্ভিস প্রকল্পে’ অংশগ্রহণ করেন। যেখানে তারা অসহায়দের সাহায্য করতে কাজ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে ঈদ উদযাপনগুলো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মিশ্রণ, যেখানে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান, সঙ্গীত শোনা এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার গ্রহণ করার রীতি পালন করা হয়।

আরও পড়ুন