নোটিশ: বকেয়া পরিশোধ না হওয়ায় সাইটটি শীঘ্রই সাসপেন্ড হয়ে যাবে, অনুগ্রহ পূর্বক যোগাযোগ করুন। ধন্যবাদ।

ভাগ্যের পালাবদলের রাতে ৯ গোলের থ্রিলারে শেষ হাসি বার্সে।

Logo
বুধবার ২২ জানুয়ারি ২০২৫

খ্যাতিমান কোনো নাট্যকার বা সিনেমার গল্পলেখককেও যেন হারিয়ে দিল বেনফিকা-বার্সেলোনা ম্যাচ। একের পর এক দৃশ্যপট পরিবর্তন, বারবার ভাগ্যদেবীর রসিকতা, ২ গোলে পিছিয়ে পড়ার পর জানুয়ারির শীতে বৃষ্টির হানা, ব্যবধান কমিয়ে ফের ২ গোলে পিছিয়ে পড়া এবং একেবারে শেষ মুহূর্তে হারতে গিয়েও অকল্পনীয়ভাবে জিতে যাওয়া— বিশ্বের দুর্দান্ত সব থ্রিলার গল্পের চেয়ে কোনো অংশেই কম কিছু ছিল না। এসবের জেরে পুরোটা সময় আনন্দে টইটম্বুর থেকে ম্যাচশেষে গোমড়া মুখে মাঠ ছাড়তে হয়েছে বেনফিকার সমর্থকদের। ‘অবিচার করা হয়েছে’ ভেবে রাতের ঘুম তাদের হবে কি না, বলা মুশকিল।

মঙ্গলবার রাতে পর্তুগালের দা লুস স্টেডিয়ামে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সপ্তম রাউন্ডের ম্যাচে স্বাগতিকদের ৫-৪ গোলে হারিয়েছে বার্সেলোনা।

এর ফলে সাত ম্যাচে ৬ জয়ে ১৮ পয়েন্ট নিয়ে এক ম্যাচ বাকি থাকতেই টেবিলের চূড়ায় থাকা লিভারপুলের সঙ্গে শেষ ষোলো নিশ্চিত করেছে হান্সি ফ্লিকের শিষ্যরা।

ভানগেলিস পাভলিদিসের প্রথমার্ধের হ্যাটট্রিকের পর দ্বিতীয়ার্ধে রোনালদ আরাউহোর আত্মঘাতী গোল, সব মিলিয়ে চার গোল করে বেনফিকা। অপরদিকে, দুই অর্ধে পেনাল্টি থেকে দুই গোল করেন রবের্ট লেভানডোভস্কি এবং এরিক গার্সিয়ার একটি ও রাফিনিয়ার জোড়া গোলে জয় নিশ্চিত করে বার্সেলোনা।

এদিন খেলা শুরুর পরপরই বেনফিকার দুর্দান্ত একটি আক্রমণে গোল খেয়ে বসে বার্সেলোনা। দ্বিতীয় মিনিটে নিজেদের অর্ধ থেকে সতীর্থের কাছ থেকে আসা উড়ন্ত পাস ধরে বাঁ পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে প্রতিপক্ষের বক্সের মধ্যে ক্রস দেন আলভারো কারেরাস। অসাধারণ ভলিতে প্রথম স্পর্শেই তা থেকে সমর্থকদের উল্লাসের উপলক্ষ এনে দেন পাভলিদিস।

গোল খাওয়ার পর আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলা শুরু করে বার্সেলোনা, অপরদিকে বেনফিকাও সফরকারীদের ছেড়ে কথা বলার মনোভাব দেখায় না। ফলে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে উত্তেজনার পারদ চড়ে খেলায়।

এরই ধারাবাহিকতায় ম্যাচের ত্রয়োদশ মিনিটে পেনাল্টি থেকে পাওয়া গোলে সমতায় ফেরে কাতালান জায়ান্টরা। বেনফিকার বক্সের মধ্যে বল নিয়ে ঢোকার পর আলেহান্দ্রো বালদের শট প্রতিহত করতে গিয়ে তার পায়ে পাড়া দিয়ে বসেন দলটির পর্তুগিজ ডিফেন্ডার তমাস আরাউহো।

শুরুতে বার্সেলোনার খেলোয়াড়রা আবেদন করেনি, রেফারিও গুরুত্ব দেনটি বিষয়টিতে। তবে কিছুক্ষণ পর ভিএআর বক্স থেকে রেফারিকে রিভিউ দেখার কথা জানানো হয়। এরপর টাচলাইন মনিটর থেকে রিভিউ দেখে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি, আর নিখুঁত স্পট কিকে দলকে সমতায় ফেরান লেভানডোভস্কি।

আক্রমণের ধারা অব্যাহত রাখার পরিপ্রেক্ষিতে ২০তম মিনিটে দ্বিতীয় গোল পেয়েই গিয়েছিল বার্সেলোনা, তবে গাভির সেই ভলি বেনফিকা গোলরক্ষক আনাতোলি ত্রুবিনের হাতে লেগে প্রতিহত হয়।

এর দুই মিনিট পর বার্সা গোলরক্ষক ভয়চিয়েখ স্টান্সনি ও বালদের ভুল বোঝাবুঝিতে ফের বেনফিকাকে এগিয়ে নেন পাভলিদিস।

বেনফিকার অর্ধ থেকে আরও একটি উড়ন্ত লং পাস এলে প্রতিপক্ষে যাতে আগে থেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, সে লক্ষ্যে ডি-বক্স ছেড়ে অনেকটা উপরে চলে আসেন স্টান্সনি। এ সময় বল ধরতে দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসেন বালদেও। পরে দুজনের মধ্যে সংঘর্ষ হলে বল চলে যায় প্রতিপক্ষের পায়ে, আর এগিয়ে গিয়ে ফাঁকা পোস্টে নিজের দ্বিতীয় গোলটি করেন নেন এই গ্রিক ফরোয়ার্ড।

দ্বিতীয়বার এগিয়ে গিয়ে উজ্জীবীত হয়ে ওঠে বেনফিকা। দুর্দান্ত গতি আর আক্রমণের পসরা মেলে দলটির খেলোয়াড়রা। আর তাতেই হতাশ হয়ে মাথা গুলিয়ে ফেলেন স্টান্সনি।

৩০তম মিনিটে বাজে একটি ফাউল করে বেনফিকাকে পেনাল্টি উপহার দেন এই পোলিশ গোলরক্ষক। তা থেকে দলের ব্যবধান বাড়িয়ে ৩০ মিনিটের মধ্যেই নিজের হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন পাভলিদিস।

আধঘণ্টার মধ্যে তিন গোল খেয়ে খেই হারিয়ে ফেলে বার্সেলোনার ফুটবলাররা। মাঠের খেলায় তাদের হতাশা ফুটে ওঠে বারবার।

বার্সেলোনা যখন হতাশায় আচ্ছন্ন, ভাগ্যদেবতা তখন আরও নির্দয় হলেন তাদের ওপর। জানুয়ারির শীতের মধ্যে শুরু হলো টিপ টিপ বৃষ্টি।

তবে বৃষ্টির মধ্যেও আবারও ধাতস্ত হয়ে ম্যাচে ফেরার চেষ্টা শুরু করেন পেদ্রি-গাভিরা। পজেশন ধরে রেখে বিরতির আগেই ব্যবধান কমানোর চেষ্টায় মনোযোগী হন লেভা-লামিন-রাফিনিয়ারা।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাচের ৪৫তম মিনিটে দারুণ একটি সুযোগও আসে তাদের সামনে। তবে লেভার বাড়ানো নিচু ক্রস গোলমুখে পেয়েও গোল করতে ব্যর্থ হন রাফিনিয়া। ফলে ৩-১ গোলে পিছিয়ে থেকেই বিরতিতে যায় ফ্লিকের দল।

বিরতির মাঠে নেমেই প্রথম কয়েক মিনিট প্রবল চাপ দিয়ে চতুর্থ গোলটি আদায় করে বার্সাকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দেওয়ার চেষ্টা করে বেনফিকা, তবে প্রতিপক্ষের চাপ সামলে ধীরে ধীরে নিজেদের স্বভাবজাত খেলায় ফেরে কাতালানরা। এ সময় কয়েকটি আক্রমণও শানায় বার্সেলোনা। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত গোল কোনোভাবেই আসছিল না।

পঞ্চাশ মিনিটের পর থেকে ফের বেনফিকার কোর্টে যায় বল। এবার মুহূর্মুহূ আক্রমণে বার্সার আগে থেকেই টলতে থাকা রক্ষণে ভীতি ছড়ায় পর্তুগিজ দলটি। এর সঙ্গে অঝোর ধারায় নামে বৃষ্টি। দুর্যোগের সুযোগ নিয়ে এর মাঝে অন্তত দুটি পরিষ্কার গোলের সুযোগ আসে ব্রুনো লাজের শিষ্যদের সামনে, তবে বার্সা ডিফেন্ডারদের প্রচেষ্টা ও গোলরক্ষকের দক্ষতায় ভর করে জাল অক্ষত রাখতে সমর্থ হয় তারা।

এরপর ম্যাচের ৬৪তম মিনিটে ভাগ্যের জোরে দ্বিতীয় গোলটি পেয়ে যায় কাতালানরা। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে গোল কিক নেন ত্রুবিন, আর শটটি ডি-বক্সের কিছুটা সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাফিনিয়ার মাথায় লেগে কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢুকে যায় গোলে।

গোল পেয়েই সমতায় ফিরতে আরও মনোযোগী হয় বার্সেলোনা। কিন্তু ভাগ্যদেবতা তখন মুচকি হাসছেন, চার মিনিট পর আরাউহোর আত্মঘাতী গোলে ফের দুই গোলে এগিয়ে যায় বেনফিকা।

৬৮তম মিনিটে বাঁ পাশ থেকে গোলমুখে আসা ক্রসটি সহজেই তালুবন্দি করতে পারতেন স্টান্সনি। প্রতিপক্ষের তেমন চ্যালেঞ্জ না থাকায় ক্লিয়ার করতে পারতেন আরাউহোও। কিন্তু ভেজা মাঠে স্লাইড করা আরাউহোর হাঁটুতে লেগে বল জালে জড়িয়ে যায়।

ম্যাচের ৭৮তম মিনিটে আবারও পেনাল্টি পায় বার্সেলোনা, আবারও স্পট কিক নেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল পেনাল্টি-টেকার লেভানডোভস্কি। আর অনুমিতভাবে গোল করে স্কোরলাইন ৪-৩ করেন এই পোলিশ তারকা।

ডি-বক্সের মধ্যে বেনফিকার এক ডিফেন্ডার লামিনের জার্সি টেনে ধরে ফেলে দিলে বার্সাকে দ্বিতীয় পেনাল্টি দেন রেফারি।

দ্বিতীয়বার ব্যবধান কমিয়ে শেষের দশ মিনিট সমতায় ফেরার মিশন শুরু করে বার্সেলোনা। পুরো ম্যাচের হতাশা ঝেড়ে ফেলে নতুন উদ্যোমে আক্রমণে উঠতে থাকে তারা, তবে এবার আরও ঠান্ডা মাথায়, ত্রুটিমুক্ত ফুটবল খেলতে থাকে তারা।

এর ধারাবাহিকতায় নির্ধারিত সময়ের চার মিনিট বাকি থাকতে দ্বিতীয়বারের মতো বার্সেলোনাকে সমতায় ফেরান বদলি নামা ডিফেন্ডার এরিক গার্সিয়া।

বাঁ পাশ দিয়ে আক্রমণে উঠে সতীর্থের কাছ থেকে পাস পেয়ে বক্সের কিছুটা সামনে থেকে দারুণ এক ফ্লিকে তা দূরের পোস্টের দিকে উড়িয়ে দেন পেদ্রি, বেনফিকার একগাদা খেলোয়াড়ের মধ্যে থেকে লাফিয়ে উঠে হেডারে লক্ষ্যভেদ করেন গার্সিয়া।

ম্যাচের এক মিনিট বাকি থাকতে পাল্টা আক্রমণে উঠে বার্সা গোলরক্ষককে একা পেয়ে গিয়েছিলেন আনহেল দি মারিয়া, কিন্তু অসাধারণ নৈপুণ্যে শেষ মুহূর্তে তার শটটি ঠেকিয়ে নিজের আগে করা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেন স্টান্সনি। আর এভাবেই শেষ হয় নির্ধারিত নব্বই মিনিট।

প্রায় পুরো ম্যাচ দুই গোলে পিছিয়ে থেকে ড্র করাও বার্সেলোনার জন্য যখন ‘প্রাপ্তি’ বলে মনে হচ্ছিল, সমতায় শেষ হওয়ার দিকেই যখন গড়াচ্ছিল ম্যাচ, অন্তত এক পয়েন্টর সান্ত্বনা নিয়ে যখন ভিজে জবুথবু হয়ে যাওয়া বেনফিকা সমর্থকরা মাঠ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ভাগ্যদেবতা তখন ফের হাসলেন। দলের দুর্দান্ত আক্রমণ দেখে জয়ের আসায় ফের চেয়ারে বসে পড়লেন অনেকে, আর তখনই নাটকের চরম দৃশ্যের অবতারণা হলো।

বেনফিকার প্রায় গোল করার সুযোগ, পেনাল্টির আবেদন ছাপিয়ে ফেররান তোরেসের শূন্যে ভাসিয়ে দেওয়া বল ছুটে গিয়ে ধরে এগিয়ে গিয়ে বক্সে ঢুকে পড়লেন রাফিনিয়া। এরপর একটু থেমে দুই ডিফেন্ডারের মাঝ দিয়ে দূরের পোস্টে নিখুঁত শট নিলেন তিনি, সেইসঙ্গে অসংখ্য বৃষ্টির শর ভেদ করে গোলরক্ষকের প্রসারিত হাতের নাগাল পেরিয়ে জালের মধ্যে আছড়ে পড়ল বল। আর দড়িতে জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বার্সেলোনা সমর্থকদের জন্য ছোটালো আনন্দের ফোয়ারা।

গোলের বাঁশি বাজানোর পর রেফারিকে ঘিরে ধরেন বেনফিকার খেলোয়াড়রা। তাদের দাবি, ওই গোলের আগে বার্সার বক্সে ফেলে দেওয়া হয়েছে তাদের এক সতীর্থকে, পেনাল্টি পেয়েছেন তারা। তবে রেফারি তাতে কান দিলেন না। কড়া জবাব দিয়ে বাজিয়ে দিলেন শেষের বাঁশি। সঙ্গে সঙ্গে যে যার মতো করে উদযাপন শুরু করলেন ব্লাউগ্রানারা। অনেকের মুখ তখন শূন্যে নিক্ষিপ্ত; দেবতার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন, নাকি আবেগে কাঁদছেন—বৃষ্টির কারণে ক্যামেরার লেন্স ঝাঁপসা হয়ে যাওয়ায় সেসব আর বোঝা গেল না।

দিনের অপর ম্যাচে দশজনের লিলকে ২-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এবারের আসরে জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছে লিভারপুল। তবে চমক দেখিয়েছে আতলেতিকো মাদ্রিদ। ম্যাচের ২৫তম মিনিটে দশজনের দলে পরিণত হয়েও দুর্দান্ত বায়ের লেভারকুজেনের বিপক্ষে ২-১ গোলের জয় তুলে নিয়েছে দিয়েগো সিমিওনের শিষ্যরা। অবশ্য ৭৬তম মিনিটে মাঠ ছাড়তে হয় লেভারকুজেনের এক খেলোয়াড়কেও।

এছাড়া স্ব স্ব ম্যাচে জয় পেয়েছে আতালান্তা, আইন্ডহোভেন ও স্টুটগার্ট; ক্লাব ব্রুজের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে প্লে-অফ এড়ানোর সুযোগ নষ্ট করেছে ইউভেন্তুন্স এবং মোনাকো ও বোলোনিয়ার কাছে হেরেছে যথাক্রমে অ্যাস্টন ভিলা ও বরুশিয়া ডর্টমুন্ড।

 

আরও পড়ুন