ঢাকায় কাতারের বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স
লন্ডন ক্লিনিকে চিকিৎসা নিবেন খালেদা জিয়া
থাকতে পারেন দেড়-দুই মা
উন্নত চিকিৎসায় মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যে যাবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। রাত ১০টায় তিনি রয়েল কাতার আমির এয়ার অ্যাম্বুলেন্স অ্যাম্বুলেন্সযোগে রওনা দেবেন। পরদিন যুক্তরাজ্যে পৌঁছে খালেদা জিয়া ভর্তি হবেন লন্ডন ক্লিনিকে। সচরাচর যেখানে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি ধনাঢ্য ব্যক্তিরা চিকিৎসা নিতে যান। এই হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন থাকবেন। আরও উন্নত চিকিৎসায় প্রয়োজন হলে সেখানে থেকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী ও একান্ত সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার সময়ের আলোকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, মঙ্গলবার রাত ৮টায় গুলশানের বাসভবন ফিরোজা থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরের উদ্দেশ্য রওনা হবেন খালেদা জিয়া। সেখানে এক ঘণ্টা ইমিগ্রেশনের কাজ শেষে রাত ১০টায় যুক্তরাজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন। তারা সার্বিক নিরাপত্তার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিত করা হয়েছে। সাত্তার বলেন, ম্যাডামসহ আমরা মোট ১৬ জন সদস্য যুক্তরাজ্যে যাচ্ছি। লন্ডন ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে চিকিৎসকরা পরামর্শ দিলে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া হবে ম্যাডামকে। আমরা সেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। এজন্য সেখানে না যাওয়ার আগ পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না সব চিকিৎসা শেষ করতে কতদিন সময় লাগতে পারে।
আরেক সফরসঙ্গী ও বিএনপি চেয়াপারসনের উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরী সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের সব প্রস্তুতি শেষ। মঙ্গলবার সকালে আমাদের কিছু কাজ বাকি আছে। ম্যাডাম কতদিন চিকিৎসা নিবেন এটা দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড বলতে পারবে। বোর্ড যেভাবে পরামর্শ দিবেন সেভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। গতকাল সন্ধ্যায় মেডিকেল বোর্ডের একজন সদস্য সময়ের আলোকে বলেন, ম্যাডাম লিভার থেকে শুরু করে নানা জটিলতায় আক্রান্ত।
লম্বা চিকিৎসা নিতে দেড় দুই মাসের মতো সময় লাগার কথা। কিন্তু এর আগে সুস্থ হয়ে গেলে তিনি দেশে চলে আসবেন। আর খালেদা জিয়ার দেশের বাইরে থাকার মানুষ নন। মন সায় না দিলে চলে আসবেন। সফরসঙ্গীদের কয়েকজন ১৫ দিনের মতো থেকে দেশে ফিরে আসবেন। ৪-৫ জনের মতো সফরসঙ্গী ম্যাডামের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত থাকার কথা রয়েছে। ম্যাডাম নিজে সফরসঙ্গী ঠিক করে দিয়েছেন। বিদেশ চিকিৎসার বিষয়টি তত্ত্বাবধান করছেন ম্যাডামের পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান।
তিনি জানান, খালেদা জিয়া সোমবার সারাদিন বিশ্রামে ছিলেন। চিকিৎসকরা শেষবারের মতো তাকে ফলোআপ করেছেন। তিনি সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেছেন। দলীয় ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা খালেদা জিয়াকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন। আত্মীয় স্বজনসহ সবার সঙ্গে খোশমেজাজে কথা বলেছেন। ওইদিন বিএনপি চেয়াপরাসনের কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ব্যস্ত সময় পার করেছেন।
জানা গেছে, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার জেনে রাজকীয় বহরের এই বিশেষ বিমান পাঠিয়েছেন। সোমবার রাত পৌনে আটটার দিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি এ-৩১৯ হয়রত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখানে অ্যাম্বুলেন্সের চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের স্বাগত জানান চেয়াপারসনের উপদেষ্টা এনামুল হক চৌধুরী। আমিরের পাঠানো এই বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে আছেন কাতারের ৪ জন চিকিৎসক এবং প্যারা মেডিকস (অ্যাম্বুলেন্স কর্মী)। সফরের এক ফাঁকে বড় ছেলে তারেক রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিয়ে খালেদা জিয়া ওমরাহ করতে পারেন বলে জানা গেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার মায়ের সঙ্গে দেশে ফিরতে পারেন বলেও শোনা যাচ্ছে। যদিও বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
জানা গেছে, সফর সঙ্গীদের মধ্যে থাকছেন খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের ছয়জন চিকিৎসক। তারা হলেন- অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার, অধ্যাপক এফএম সিদ্দিক, অধ্যাপক নুরুদ্দিন আহমেদ, ডা. জাফর ইকবাল, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন ও ডা. মোহাম্মদ আল মামুন। এছাড়া সফর সঙ্গীদের মধ্যে রয়েছেন খালেদা জিয়ার প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এনামুল হক চৌধুরী, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল ও বেগম জিয়ার একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার, সহকারী একান্ত সচিব মো. মাসুদুর রহমান ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা এসএম পারভেজ, গৃহপরিচারিকা ফাতেমা বেগম এবং রুপা শিকদারসহ ব্যক্তিগত কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী।
বেগম জিয়ার বিদেশ চিকিৎসা নিয়ে সোমবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে আসেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী লন্ডন ক্লিনিক হাসপাতালে খালেদা জিয়াকে ভর্তি করা হবে। হিথ্রো এয়ারপোর্টে থেকে উনাকে সরাসরি সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন থাকবেন। মঙ্গলবার রাত ১০টায় কাতারের আমিরের স্পেশাল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ম্যাডাম ঢাকা হয়রত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে ঢাকা-দোহা এবং দোহা-লন্ডনের হিথরো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন।
জাহিদ বলেন, আপনাদের মাধ্যমে সকলের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই যারা ম্যাডামের সুস্থতার জন্য দোয়া করেছেন, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বিভিন্নভাবে প্রার্থনা করেছেন তাদের সবার কাছে দলের পক্ষ থেকে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই। চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে উনি যাতে আমাদের মাঝে ফেরত আসতে পারেন সেজন্য ম্যাডামের পরিবার দোয়া চেয়েছেন।
জাহিদ বলেন, ম্যাডামের নানা শারীরিক জটিলতা রয়েছে যা আমরা বিভিন্ন সময়ে বলেছি। সর্বোপরি উনার লিভারের জটিলতাটা অর্থাৎ লিভার সিরোসিস পরবর্তীতে কম্পেনসেন্টারি লিভার ডিজিজ বলে গ্রেট-টু সেটার জন্য টিপস (চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশেষ পদ্ধতি টিআইপিস-টিপস) করা হয়েছে। টিপসের কিছু টেকনিক্যাল অ্যাসপেক্ট আছে এডজাস্টমেন্টের বিষয় আছে। আপনি দেখতে হার্টে স্টেন্টিং করার পর চেক করে আবার সেটার জন্য রি-স্টেন্টিং করে অথবা চেক করে দেখে যে, স্টেন্টিংটা ভালোভাবে কাজ করছে কিনা, এই জিনিসগুলো তো আমরা করতে পারিনি। তিনি বলেন, লিভার ট্রান্সপারেন্টের বিষয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে উনার যে বয়স লিভার ট্রান্সপারেন্টের বিষয়টি সিদ্ধান্ত দেবে লিভার ট্রান্সপারেন্ট ইউনিটে যাওয়ার পর। ওখানে ওই সুবিধাটা আছে। সেখানকার চিকিৎসকরা উনাকে দেখে তারপরে ডিসিশন হবে উনার নেক্সক্ট কোর্স অফ ডিসিশন কি হবে? পবিত্র ওমরাহ পালনে সৌদি আরব যাবেন কিনা এরকম প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুস্থ থাকলেই ফেরার সময়ে বা কোনো এক সময়ে ডেফিনেটলি ম্যাডাম ওমরা করতে পারেন। এটা কিন্তু প্রি ডিসাইড না যে, এটা করবেনই।
২০১৭ সালের ১৬ জুলাই সর্বশেষ যুক্তরাজ্যে যান খালেদা জিয়া। ওই বছরের ১৮ অক্টোবর দেশে ফেরেন তিনি। সেই সময় খালেদা জিয়া যুক্তরাজ্যের ডা. হ্যাডলি ব্যারির চিকিৎসা গ্রহণ করেন। ওই সময় লন্ডনে থাকা ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এরপর আর মা ছেলের দেখা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আসন্ন তার এই সফরকে নির্বিঘ্ন করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিয়েছে। এই সফরে ভিআইপি প্রটোকল পাবেন খালেদা জিয়া। ইতোমধ্যে বিএনপির তরফ থাকে বাড়তি নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে খালেদা জিয়ার জন্য। যাত্রাকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরে নেওয়া হয়েছে কয়েক স্তরের বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিএনপির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর বিমানবন্দরে আগমনকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যেন বিঘ্ন না ঘটে, তার জন্য বিশেষ এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বিমানবন্দরের বাইরে (ল্যান্ডসাইড) নিরাপত্তায় এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের পাশাপাশি থাকবে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), ডিবি এবং সোয়াটের মতো স্পেশাল টিমের সদস্যরাও।
দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত সাবেক চেয়ারপার্সন বেগম জিয়া ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্ত থাকলেও এবার সরকার পতনের একদিন পর সাজা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পান। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর দণ্ড মওকুফ করেন।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় খালেদা জিয়াকে। তিনি তখন পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কের কারাগারে ছিলেন। দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর পরিবারের আবেদনে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নির্বাহী ক্ষমতায় খালেদার দণ্ড ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। তখন থেকে তিনি গুলশানের বাসা ফিরোজায় আছেন।
এরপর থেকে পরিবারের আবেদনে প্রতি ছয় মাস পরপর বিএনপি নেত্রীর মুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে আসছিল শেখ হাসিনার সরকার। প্রতিবারই তাকে দুটি পারবেন না। তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য পরিবারের তরফ থেকে বেশ কয়েকবার আবেদন করা হলেও ওই শর্তের যুক্তি দিয়েই বার বার তা প্রত্যাখ্যান করেছে সাবেক শেখ হাসিনা সরকার।