গত ২ মে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে দেশীয় এয়ারলাইন্স নভোএয়ার। এটি আবারও অপারেশনে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এভাবে গত ২৫ বছরে দেশীয় ১০টি এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে গেছে। এখন টিকে আছে মাত্র ৩টি এয়ারলাইন্স। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও ইউএস-বাংলা নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে ফ্লাইট চালিয়ে যাচ্ছে। সেই তুলনায় এয়ার অ্যাস্ট্রা একেবারেই নবীন। যারা এখনও কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। বাংলাদেশে আকাশপথে যাত্রী থাকা সত্ত্বেও দেশি এয়ারলাইন্সগুলো চাহিদা পূরণ করতে না পারায় বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো প্রায় ৮০ শতাংশ বাজার দখল করে নিয়েছে। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। বিমান বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশি অ্যাভিয়েশন খাত এখন হুমকির মুখে রয়েছে।
দেশি এয়ারলাইন্সগুলো টিকতে না পারা অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ডলার সংকটের পেছনে এটা বড় ভূমিকা পালন করছে। কারণ বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোকে ডলারে পেমেন্ট করতে হয়। দেশি এয়ারলাইন্সগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে এয়ারলাইন্স সংস্থার ভুল ব্যবসানীতি এবং সরকার ও রেগুলেটরি বডির কঠোর নিয়ম-নীতি ও সহযোগিতা না করার মনোভাব দায়ী। পাশাপাশি উচ্চ পরিচালন ব্যয়, জেট-জ্বালানির দাম এবং অতিরিক্ত সারচার্জ শিল্পের বোঝা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
তারা মনে করছেন, এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় লোকসানি প্রতিষ্ঠান বিমান ছাড়া কোনো এয়ারলাইন্সই দেশে থাকবে না।
নভোএয়ার জানিয়েছে, তাদের বহরে থাকা উড়োজাহাজগুলো কেনার জন্য বায়ার আসায় আপাতত ফ্লাইট চালানো বন্ধ রাখা হয়েছে। তাদের অর্থ সংকট রয়েছে, ইনভেস্টরের সঙ্গে আলোচনা চলছে। ইনভেস্টর পাওয়া গেলে উড়োজাহাজ বিক্রি নাও করা হতে পারে বা বিক্রি হলেও নতুন উড়োজাহাজ কেনা হবে। তবে কবে নাগাদ ফ্লাইট পুনরায় চালু হতে পারে তা নিশ্চিত করতে পারেনি এয়ারলাইন্সটি। এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কোনো এয়ারলাইন্সের ফিরে আসার নজির দেশে নেই। এর আগে সবশেষ ২০২০ সালের মার্চে পাখা গোটায় বেসরকারি এয়ারলাইন্স রিজেন্ট এয়ার। ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করেছিল এয়ারলাইন্সটি।
বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি বিমান সংস্থা জিএমজি এয়ারলাইন্স ১৯৯৭ সালে তাদের কার্যক্রম শুরু করে এবং আর্থিক দুরবস্থার কারণে ২০১২ সালে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১০ জুলাই, ২০০৭ সালে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। ২০১৬ সালের ৬ মার্চ থেকে বিমান সংস্থাটি সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি এয়ারলাইন্স হিসেবে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট শুরু করে ‘অ্যারো বেঙ্গল এয়ারলাইন্স’। তবে অতিরিক্ত ল্যান্ডিং ও পার্কিং চার্জ (ওয়াইড বডি এয়ারক্রাফটের সমান) এবং ওয়েটিং চার্জ বেশি থাকায় ৪ বছরের মাথায় ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয় এয়ারলাইন্সটি।
২০০৭ থেকে ২ বছর ফ্লাইট পরিচালনা করে বন্ধ হয় ‘বেস্ট এয়ার’। ২০০৫ সালে চালু হয় ‘এয়ার বাংলাদেশ’ এবং ২০০৭ সালে চালু হয় ‘রয়েল বেঙ্গল এয়ারলাইন্স’। অব্যাহত লোকসানের কারণে এ দুটি এয়ারলাইন্সও বন্ধ হয়ে যায়।
এর মধ্যে রিজেন্ট, ইউনাইটেড ও জিএমজি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করত। এ ৩টি এয়ারলাইন্স আবারও অপারেশনে ফেরার আগ্রহ প্রকাশ করলেও বেবিচকের কাছে থাকা অতিরিক্ত বকেয়ার কারণে আর ফিরতে পারেনি।
বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনাকারী এয়ারলাইন্সগুলোর মালিকরা বলছেন, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) বকেয়া পাওনার ওপর মাসে ৬ শতাংশ হারে বছরে ৭২ শতাংশ সারচার্জ দিতে হয়। এত চার্জ কোনো দেশেই নেই। এ দেনা শোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এয়ারলাইন্সগুলো।
কয়েকটি দেশের সিভিল অ্যাভিয়েশনের ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা যায়, সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশে বার্ষিক সারচার্জ ৮ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১২ শতাংশ, ওমানে ১০ শতাংশ এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এয়ারলাইন্সভেদে ১২ থেকে ১৮ শতাংশ।
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ৬টি এয়ারলাইন্সের কাছে বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি বকেয়া রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশের কাছে। তাদের বকেয়ার পরিমাণ ৬ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। আর বেসরকারি মালিকানাধীন পাঁচটি বিমান সংস্থার কাছে বেবিচকের পাওনা ১ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সারচার্জের পরিমাণ ৯১৪ কোটি টাকা। বন্ধ হয়ে যাওয়া রিজেন্ট এয়ারওয়েজ, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এবং জিএমজি এয়ারলাইন্সের কাছে পাওনা বকেয়া ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। রিজেন্ট এয়ারওয়েজের বেবিচকের মোট ৪০৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। মোট বকেয়ার মধ্যে বিমান সংস্থার মূল ঋণের পরিমাণ ১৪১ কোটি টাকা, বাকি ২৩৭ কোটি টাকা ঋণের ওপর আরোপিত সারচার্জের কারণে।