জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাকে ভারতের কাছে ফেরত চেয়েছে সরকার।গত সপ্তাহে এক কূটনৈতিক নোটের মাধ্যমে তাকে ফিরিয়ে দিতে বলেছে ঢাকা। ভারত ইতিমধ্যে চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করেছে। তবে এর বাইরে কোনো মন্তব্য করেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত তাদের ঋণ শোধ করছে। বিষয়টি অনেক জটিল। শেষ পর্যন্ত তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা যাবে কি না তা নিশ্চিত নয়।
সোমবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল হাসিনাকে ফেরত চেয়ে ঢাকার পাঠানো কূটনৈতিক নোট পাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেন। দেশটির ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন অনুযায়ী নয়াদিল্লিতে এক ব্রিফিংয়ে জয়সওয়াল বলেছেন, ‘আমি নিশ্চিত করছি যে, আমরা আজ বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছ থেকে প্রত্যর্পণের অনুরোধের বিষয়ে একটি কূটনৈতিক নোট পেয়েছি। তবে এই মুহূর্তে এ বিষয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই।
যেকোনো অপরাধীর প্রত্যর্পণে বাংলাদেশ-ভারত গত ২০১৩ সালে একটি চুক্তি করেছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, দিল্লি থেকে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য ২০১৩ সালের চুক্তি অনুসরণ করছে ঢাকা। ওই চুক্তিটি গত ২০১৬ সালে সংশোধন করা হয়। ওই চুক্তির ১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, বাংলাদেশ ও ভারত তাদের ভূখণ্ডে কেবল সেই ব্যক্তিদের প্রত্যর্পণ করতে বাধ্য, যারা প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ করেছেন।
প্রত্যর্পণ চুক্তির অনুচ্ছেদ ১০ ধারায় বলা আছে, এই চুক্তির আওতায় প্রত্যর্পণ চাওয়ার জন্য অনুরোধকারী রাষ্ট্রের পক্ষে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা যথেষ্ট। চুক্তির অনুচ্ছেদ ৮ ধারায় বলা আছে, যদি একজন ব্যক্তি প্রত্যপর্ণের জন্য অনুরোধকৃত রাষ্ট্রকে বোঝাতে পারেন যে, তাকে হস্তান্তর করা হলে দেশে তিনি ন্যায়বিচার পাবেন না এবং তাকে প্রত্যর্পণ করাটা নিপীড়নমূলক হবে, তা হলে অনুরোধকৃত রাষ্ট্র সব পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাকে প্রত্যর্পণ করা থেকে বিরত থাকতে পারে।
এই অনুচ্ছেদ অনুসারে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ‘ন্যায়বিচারের স্বার্থে সরল বিশ্বাসে’ করা হয়নি বলে জানাতে পারবে অনুরোধকৃত রাষ্ট্র। আবার চুক্তির অনুচ্ছেদ ২১ ধারা অনুযায়ী ভারত যেকোনো সময় নোটিস দিয়ে এই চুক্তি বাতিল করতে পারবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২ দেশের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় থাকলে যেকোনো বিষয়ে সুরাহা করতে চুক্তি কোনো বিষয় না। দুই পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক ঠিক থাকলে এমন চুক্তি না থাকলেও যেকোনো বন্দিকে ফিরিয়ে আনা যায়, আবার সম্পর্ক উষ্ণ না হলে চুক্তি থাকলেও ফেরত পাওয়া যায় না। এ ছাড়া শেখ হাসিনা এবারই প্রথমবারের মতো দিল্লির আশ্রয় নেয়নি। এর আগেও পঁচাত্তর সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর বিগত ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর শেখ হাসিনা দিল্লির আশ্রয়ে ছিলেন। তখনও ভারত তাকে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে আশ্রয়ে রেখেছিল। শেখ হাসিনা ছাড়াও তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামা এবং আফগান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহর স্ত্রী-সন্তানসহ এশিয়ার একাধিক নেতাকে আশ্রয় দিয়েছে ভারত। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারতের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই শেখ হাসিনাকে দিল্লি থেকে সহজে ফেরত পাচ্ছে না ঢাকা।
সাবেক শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি খুব জটিল। গত ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপড়েন বেড়েই চলছিল। যার মধ্যে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার জন্য গত ৯ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশ সফর করেন। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এমন একসময়ে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ভারতকে নোট ভারবাল দিয়েছে যা যথাযথ সময়োপযোগী না। এখানে বাংলাদেশের আরও কৌশলী ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল। কেননা শেখ হাসিনাকে ফেরত পাওয়া বাংলাদেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
বাংলাদেশ-ভারত পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে এই ইস্যুটি উত্থাপন করার পর নোট ভারবাল দিলে অনেক ভালো হতো। কেননা ভারত সব জেনেবুঝেই শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। এখন ভারত চাইলে আইনের ফাঁকফোকরের রেহাই দিয়ে শেখ হাসিনাকে ফেরত না দেওয়ারও বার্তা দিতে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আদালতে একাধিক মামলা হয়েছে। আদালত থেকে তাকে গ্রেফতারের জন্য সমন জারি হয়েছে। জানতে পারলাম যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নোট ভারবালের মাধ্যমে ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়েছে। দুই দেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তিও আছে। কিন্তু বিষয়টি এত সহজ হবে না। কারণ হচ্ছে যে এসব চুক্তির অনেক ফাঁকফোকর আছে। ক্ষমতাসীন দেশ চাইলে এসব চুক্তি ম্যানিপুলেট করতে পারে। এমন হলে তখন সম্পর্কে বৈরিতা আরও বাড়বে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, কূটনীতিতে ভারবাল নোট হাই ভলিউমের কোনো বার্তা না। এসব নোটের পর কোনো তড়িৎ জবাব আসার সম্ভাবনাও কম। এই নোট ব্যাখ্যা চাওয়ার পর্যায়েরও না। এই নোটের উল্লেখযোগ্য চাপও নেই। মনে হচ্ছে যে রাজনৈতিক চাপ থেকেই এমন নোট দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বে বার্তা যাচ্ছে যে ভারত বাংলাদেশের স্বৈরাচার শাসক হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। যা গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতকে বিশ্বের কাছে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ কতটুকু কাজ করবে তা সময়ই বলে দেবে।
অধ্যাপক নাজমুল বলেন, আবার এমনও হতে পারে যে হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার পর ভারত বাংলাদেশের একটা সংকটময় পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছে। যখন বাংলাদেশের মানুষ এমন বলতে পারে যে আগেই ভালো ছিলাম। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন একসময়ে ভারতের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তাদের এত দিয়েছি যে সারা জীবনেও ঋণ শোধরাতে পারবে না। আসলেই শেখ হাসিনা ভারতকে ট্রানজিটসহ একাধিক ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা দিয়েছেন। এখন হয়তো ভারত সেই ঋণ পরিশোধের সুযোগ পেয়েছে।