রবিবার ● ১২ জানুয়ারি ২০২৫
বর্তমানে শহুরে সমাজে বড় আতঙ্কের নাম ‘কিশোর গ্যাং’। উঠতি বয়সি এসব তরুণের অপরাধকর্মে আতঙ্কিত রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকা ও দেশের অন্যান্য শহরের বাসিন্দারাও। বর্তমান সময়ে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রতিটি বিভাগ-জেলা ও পাড়া-মহল্লায়
দল বেঁধে চলাচল, আধিপত্য বিস্তারসহ নিজেদের হিরোইজম জাহির করতে বিভিন্ন চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক কারবার এমনকি খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে কিশোর-তরুণরা। তবে অভিযোগ রয়েছে, কিশোর গ্যাংয়ের পেছনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী, স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি। কিছু জায়গায় তাদের ইন্ধন দিচ্ছে রাজনৈতিক নেতারাসহ শীর্ষ সন্ত্রাসীরা।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে সারা দেশের পাড়া-মহল্লাকেন্দ্রিক কিশোর গ্যাং কালচার আরও বেড়েছে। এতে সমাজে বসবাসকারী নাগরিকদের আতঙ্কও বাড়ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে মাদকের আগ্রাসন বেশি। এ আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে কিশোররা। এ কারণে তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করতে দ্বিধাবোধ করে না। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারামারি করছে, হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে তারা। সম্প্রতি অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। তাদের ছত্রছায়ায় থেকে সমাজের বিভিন্ন তাণ্ডব চালাচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এদিকে রাজধানীসহ সারা দেশেই কিশোর গ্যাং গ্রুপগুলোর বিষয়ে নজরদারি বৃদ্ধি এবং শনাক্তের কাজ করছে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট র্যাব।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে আইনের শাসনে ঘাটতি থাকায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে সমাজে। কিশোর অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবস্থাগুলোতে কিছুটা ঘাটতিও আছে, এ ঘাটতি সমাজব্যবস্থায়ও রয়েছে। পাশাপাশি আমাদের কিশোর অপরাধীদের শাস্তির চেয়ে সংশোধনের বিষয়ে গুরুত্ব বেশি দিতে হবে। পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা গেলে এ অপরাধ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
পাড়া-মহল্লারই উঠতি বয়সের বখাটে ছেলেরা জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাংয়ে। প্রভাবশালীরা নিজেদের স্বার্থে এসব কিশোরকে ব্যবহার করে আসছে। মাদকের কারবার, পাড়া-মহল্লায় আধিপত্য বিস্তার, মারামারি, এমনকি খুনাখুনি পর্যন্ত করছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। রাজধানী ঢাকায় অপরাধের শীর্ষে রয়েছে মোহাম্মদপুর এলাকা। অপরাধের হট স্পট মোহম্মদপুর-আদাবর এলাকা। জেনেভা ক্যাম্প মাদকের স্বর্গরাজ্য। এ এলাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে বিভিন্ন অপরাধ। একই সঙ্গে আদাবর, ধানমন্ডি, মিরপুর, পল্লবী, বংশাল, লালবাগ, উত্তরা, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে অসংখ্য কিশোর গ্যাং।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ডাইল্লা গ্রুপ, এলেক্স গ্রুপ, ইমন গ্রুপ, আনোয়ার ওরফে শুটার আনোয়ার গ্রুপ, আকাশ গ্রুপ, দ্য কিং অব লও ঠেলা গ্রুপ, ডায়মন্ড গ্রুপ, আই ডোন্ট কেয়ার (আইডিসি), মুরগি গ্রুপ, সাব্বির গ্রুপ, শাওন গ্রুপ, ফিল্ম ঝিরঝির, স্টার বন্ড, গ্রুপ টোয়েন্টি ফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, কোপাইয়া দে গ্রুপ। উত্তরা এলাকার গ্যাংগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইন স্টার, পাওয়ার বয়েজ, বিল বস, নাইন এম এম বয়েজ, সুজন ফাইটার, ক্যাসল বয়েজ, আলতাফ জিরো, ভাইপার, তুফান। মিরপুর এলাকায় আছে সুমন গ্যাং, পিচ্চি বাবু, বিহারি রাসেল, বিচ্চু বাহিনী, সাইফুল গ্যাং, বাবু রাজন, রিপন গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, নয়ন গ্যাং এবং মোবারক গ্যাং। ধানমন্ডিতে একে ৪৭, নাইন এম এম ও ফাইভ স্টার বন্ড। বংশালে রয়েছে জুম্মন গ্যাং, তেজগাঁওয়ে মাঈনুদ্দিন গ্যাং, মুগদায় চান জাদু, ডেভিড কিং ফল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারি। পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, কলতাবাজার, পানিটোলা, লালকুঠি, শ্যামবাজার, ইসলামপুর, বাবুবাজারসহ সদরঘাটের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ফেরদৌস গ্রুপ, সাজু গ্রুপ, সিনিয়র গ্রুপ, জুনিয়র গ্রুপ, টাইগার গ্রুপ, চিতা গ্রুপ।
পটপরিবর্তনের পর থেকে মোহাম্মদপুর এলাকায় শুরু হয় গণছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। কিশোর গ্যাং গ্রুপের মহড়া চলে আদাবরে রাস্তায় রাস্তায়। বেড়ে যায় ছিনতাই। আধিপত্য বিস্তার বা পূর্বশত্রুতার জেরে জোড়া খুনের ঘটনাও ঘটে মোহাম্মদপুর রায়েরবাগ এলাকায়। এসব অপরাধে জড়িত রয়েছে একাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ। এ বছরের শুরুতে গত ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আদাবরের মেহেদীবাগ, আদাবর বাজার এলাকায় দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় কিশোর গ্যাং সদস্যরা। এতে বাধা দেওয়ায় এলাকাবাসীর ওপর হামলা করে গ্যাং গ্রুপের কয়েকশ সদস্য। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় অর্ধশতাধিক স্থানীয় বাসিন্দা আহত হওয়ার খবরও রয়েছে। পুলিশ বলছে । আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এলাকায় কিছুদিন পরপর কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা গণছিনতাই চালায়, আবার দেশি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। সন্ধ্যার পর বাইরে বের হতে ভয় লাগে তাদের। মহড়া দেওয়ার সময় বাসাবাড়ির জানালার গ্লাস ভাঙচুর, লাইট ভাঙচুর করে গ্যাংয়ের সদস্যরা।
পুলিশ জানায়, মোহাম্মদপুর-আদাবর এলাকার চিহ্নিত মাদক কারবারিদের নেতৃত্বে চলছে কিশোর গ্যাংগুলো। একসময় স্থানীয় ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসু ও কাসুর কিশোর গ্যাংয়ের প্রধান ছিল ডিবি সুমন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হাসু ও কাসু পালিয়ে যাওয়ায় তাদের অনুপস্থিতিতে তার ভাই স্বাধীনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে সে। স্বাধীনের ইন্ধনে পুরো এলাকায় ত্রাস কায়েম করতে এমন মহড়া দিয়েছে চক্রটি।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান বলেন, ‘মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় গত চার মাসে কম করে হলেও ৪০০ আসামি গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে আমরা মোহাম্মদপুর এলাকায় কিশোর গ্যাং-ট্যাং সব ভেঙে দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে-এ সময় কিশোর গ্যাং ছিল। তখন এক-দেড়শ লোক চাপাতি নিয়ে প্রকাশ্যে রায়েরবাগ এলাকায় ডাকাতি করত। এখন তিন-চারজন মিলে একটা ছিনতাই করে এদের কি গ্যাং বলা যায়!’ ওসি আরও বলেন, ‘এ থানায় আমি আসার পর বড় কোনো গ্যাংয়ের ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেনি। হ্যাঁ, ১০/১২ জন মিলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া করেছে। ছিনতাই মোহাম্মদপুরের ঐতিহ্য হয়ে গেছে। আমরা প্রতিনিয়ত ছিনতাইকারীদের ধরে চালান দিচ্ছি, কিন্তু তারা বের হয়ে আবারও ছিনতাই কাজে লিপ্ত হচ্ছে।’
কিশোর গ্যাংয়ে কিছু অপরাধচিত্র : গত ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রায়েরবাজারে সাদেক খান কাঁচাবাজার এলাকায় কিশোর গ্যাং ‘ডাইল্লা গ্রুপ’ ও ‘এলেক্স গ্রুপের’ মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে নাসির (৩০) ও মুন্না (২২) নামে দুজন নিহত হয়। গত ৩১ ডিসেম্বর রাতে মাহবুব নামে এক তরুণ স্ত্রী ও মাকে থার্টিফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠান দেখার কথা বলে বাসা থেকে বের হন। ওই দিন রাত দেড়টার দিকে লালবাগের জেএন সাহা রোডে একটি বাড়ির ভেতরে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্য মো. মাঈন উদ্দিনসহ ১৩/১৫ জন পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মাহবুবকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে এবং লালবাগের লিবার্টি ক্লাব-সংলগ্ন রাস্তায় তার লাশ ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।
এ ঘটনায় ৪ জানুয়ারি রাতে লালবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে মাহবুব হত্যার সঙ্গে জড়িত গ্যাং গ্রুপের সদস্য মো. মাঈন উদ্দিনকে (২৬) গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করেছে। পুলিশ জানায়, গ্রেফতার মাঈন ও ভুক্তভোগী মাহবুব লালবাগ এলাকায় দুটি গ্রুপের (গ্যাং) সদস্য। মাদক কারবারসহ বিভিন্ন অপরাধসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে আগে থেকেই বিরোধ ছিল। গত ২২ ডিসেম্বর বিকালেও রাজধানীর লালবাগ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিরোধের জেরে মাহবুবকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করেছিল মাঈন উদ্দিন। হাসপাতাল থেকে মাহবুব সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে ১ জানুয়ারি তাকে হত্যা করা হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় মাহবুবের পরিবারের দায়ের করা মামলায় মাঈন উদ্দিনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে মাহবুব হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
গত ১ জানুয়ারি রাত পৌনে ৩টায় গাজীপুরে শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পশ্চিমখণ্ড (মসজিদ মোড়) এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের হামলায় ওষুধ (ফার্মেসি) ব্যবসায়ী হাসিবুল ইসলাম বাদশা (৪০) নিহত হন। এ ছাড়া তারা বাড়িতে ঢুকে তার স্ত্রী ও শ্যালিকাকে লাঞ্ছিত করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ ঘটনায় মাওনা (মসজিদ মোড়) দারগারচালা এলাকার আলী আকবরের ছেলে অন্তর (২০) এবং মৃত নিজাম উদ্দিনের ছেলে রুমানকে (২০) গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা মাদকাসক্ত ও এলাকার কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্য।
গত ৩ জানুয়ারি বিকালে কুমিল্লার কান্দিরপাড় এলাকায় অবস্থিত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শাখাসংলগ্ন রানীর দীঘির পাড়ে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেয়। এতে ওই এলাকার মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যায়। পুলিশ জানায়, কুমিল্লার আলোচিত কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপের’ অন্তত ৩০ সদস্য চাপাতি, চায়নিজ কুড়াল, রামদাসহ দেশি বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে ভিক্টোরিয়া কলেজের সামনে রানীর দীঘির পাড়ে মহড়া দেয়। এ সময় কয়েকটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। ২০২৪ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে কুমিল্লা অশোকতলা এলাকায় সজীব হোসেন ওরফে বাবু (২২) নামের এক তরুণকে পিটিয়ে ছুরিকাঘাত করা হলে পরদিন সকালে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার নেপথ্যে ছিল কিশোর গ্যাংয়ের মাদক কারবার ছিল বলে জানায় পুলিশ।
নিহত সজীবের বড় বোন সনিয়া আক্তার জানান, তার ভাই কুমিল্লা নগরে একটি সুপারশপের কর্মীর ছিল। যারা খুন করেছে, তারা ভয়ংকর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। এক তরুণীকে (১৮) উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় গত ১৪ অক্টোবর বিকাল সোয়া ৪টার দিকে ফরিদপুরের গট্টি ইউনিয়নের জয়ঝাপ গ্রামে নৌকাবাইচ উপলক্ষে আয়োজিত ইমামবাড়ী মেলায় কাশেম বেপারি নামের এক তরুণকে কুপিয়ে হত্যা করে এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় সিলেটে সাগরদীঘির পারের ১১ লগির ভেতরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পূর্ববিরোধের জেরে ছুরিকাঘাতে শাওন আহমেদ (১৭) নামে এক কিশোর খুন হয়। পুলিশ জানায়, বেশ কিছুদিন ধরে নগরের বাগবাড়ি ও সাগরদীঘি পাড়ের কিশোরদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ চলছিল কিশোরদের মধ্যে। তাদের সিনিয়ররা বিষয়টি সমাধান করে দিলেও ভেতরে-ভেতরে ক্ষোভ চলছিল। এর জেরে শাওনকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য : র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস সময়ের আলোকে বলেন, সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে মোহাম্মদপুরের ইমন গ্রুপের সদস্যদের গ্রেফতার করেছে র্যাব। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে এর আগেও র্যাবের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। পটপরিবর্তনের পর থেকে এসব কিশোর গ্যাং গ্রুপ কালচার আবার সক্রিয় হওয়া চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে র্যাব।
তিনি বলেন, পাড়া-মহল্লার এসব কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা তৈরি ও তাদের শনাক্ত করার বিষয়ে র্যাবের সব ব্যাটালিয়নকে ইতিমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা কিশোর গ্যাং গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকদের শনাক্তেও কাজ করছি।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর দৈনিক সময় ভূমিকা আছে কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জামিনে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ওপর আলাদা নজরদারি রয়েছে। তবে কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা সম্পৃক্ত নয়। আপনারা আগেও কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য দেখেছেন। তবে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা যাতে এসব গ্যাংকে কোনো পৃষ্ঠোপোষকতা করতে না পারে সে বিষয়ে পুলিশের আলাদা নজরদারি রয়েছে।’
যা বলছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা বর্তমানে তারা কৌশল পরিবর্তন করছে। ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করছে, সংঘবদ্ধভাবে শারীরিক নির্যাতন করছে। মাদকাসক্ত হওয়া ও মাদক কারবারের অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে এগুলো আরও জোড়ালো হচ্ছে। সমাজের প্রচলিত আইন কিংবা সামাজিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে কিশোরদের যে চলাফেরা, এটাও কিন্তু অপরাধ। যেসব তরুণ অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ছে, বিভিন্ন শ্রেণিকরণের মধ্য দিয়ে তাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কারণ সমাজের উচ্চবিত্ত বা আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিবারগুলো তরুণদের অপরাধ আর সমাজের সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত বেড়ে যায়। কিশোর অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে অতীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে ব্যবস্থাগুলো ছিল, আমরা দেখছি, তাতে ঘাটতি পড়েছে।
পাশাপাশি আমাদের কিশোর অপরাধীদের ক্ষেত্রে আইনে বলা আছে, তাদের শাস্তির চেয়ে সংশোধনের বিষয়ে গুরুত্ব বেশি দিতে হবে। সামাজিক গবেষণা বা অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে, ভাসমান পরিবারের কিশোর সদস্যরা বিভিন্নভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। ঘনবসতিপূর্ণ বা বস্তি এলাকার কিশোরদের যারা পরিবারের বিষয়গুলোতে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। আমরা হয়তো আইনগত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এর সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছি। কিন্তু এ সমাধান খোঁজার মধ্যে এটাও বোঝা প্রয়োজন, কেন তারা অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ছে? রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে আমাদের সমাজের একটা মহল নিজের স্বার্থ, নিজের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিলে কিশোরদের দিয়ে বিভিন্ন গ্যাং তৈরি করে তাদের অপরাধ কর্মে ব্যবহার করছে।’
প্রতিকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা খুব জরুরি। এ ছাড়া আমাদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে যে ব্যত্যয়গুলো রয়েছে সেগুলো সংশোধন করা প্রয়োজন। আইনের বিষয়গুলোতে আরও কিছু সংযোজন-বিয়োজন প্রয়োজন। পাশাপাশি যারা সমাজের দায়িত্বশীল নাগরিক রয়েছেন সমাধানের জন্য আরও উদ্যোগী হয়, তবে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’